সভ্যতার সূচনালগ্নে মানবজাতির আতংকে ছিল হিংস্র জীবজন্তু ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়।সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ এই আতংক থেকে মুক্তি পেয়েছে।প্রকৃতি ও জীবজন্তু আজ মানুষের বশে।কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল যুগে মানুষের সবচেয়ে বড় আতংকের নাম তার নিজের তৈরী সড়ক!প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ খুললেই যে খবরটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল
সড়ক দুর্ঘটনার মর্মান্তিক দুঃসংবাদ।
এই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আনেকেই মূর্খতার বশে দায়ী করে ভারী যানবাহনকে।সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে কি তবে যানবাহনের ব্যবহার কমাতে হবে?নিশ্চয়ই নয়।যদি তাই করা হয়,তবে তো সেটা-মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার শামিল। :P সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মূলদায়ী আমাদের সচেতনতা ও প্রযুক্তির স্বদ্যবহারের অভাব।উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করছে।বাজেটের এক বিরাট অংশ বরাদ্দ রাখা হয় সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য।অভিনব সব প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে খুব সহজেই তারা সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা ও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে।উন্নতদেশগুলো যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এত কিছু করছে সেখানে বাংলাদেশে দিনকে দিন সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েই চলছে।বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়,পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমার দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার ২৫% থেকে ৩০% বেশী।এটি দুঃখজনক হলেও মর্মান্তিক বাস্তব সত্য।২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৬,১৯৪ জন ও আহতের সংখ্যা ১১,৭৫৭ জন!!!
মৃত্যু সকলেরই হবে।তাই বলে কেউ দুর্ঘটনায় মারা যাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না।তাই এখন সময় এসেছে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়ার।নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে প্রযুক্তির ব্যবহারের বিকল্প নেই। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে উন্নতবিশ্বে ব্যবহৃত উল্লেখযোগ্য কিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কথা তুলে ধরা হলঃ
Car to Car Communication
সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিরসনে ইউরোপে “Car to Car Communication” নামে এক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়।অসাধারণ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাড়ী চালকেরা বিভিন্ন রাস্তার অবকাঠামো ও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারবে।একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আরও সহজভাবে বুঝানো যেতে পারে।ধরা যাক,কোনো দুর্ঘটনার কারণে একটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হল।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তখন কি হত?নিশ্চয়ই ঐ রাস্তার সামনে লম্বা গাড়ীর সারি এবং যানজট তৈরী হবে।কিন্তু এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এত সমস্যার প্রশ্নই উঠে না।কারণ দুর্ঘটনাস্থলে যখন একটি গাড়ী পৌছে দেখবে রাস্তা বন্ধ তখন সেই গাড়ী হতে একটি সংকেত কয়েক কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত যে গাড়ী থাকবে তাকে সংকেত দিয়ে জানিয়ে দিবে যে সামনে রাস্তা বন্ধ।
আবার যেই গাড়ীটিতে সংকেত পাঠানো হল সেটি আবার তার থেকে কয়েক কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত গাড়ীকে সংকেত পাঠিয়ে দিবে।এভাবে খবরটি ছড়িয়ে যাবে।ফলে অন্যান্য গাড়ীগুলো সেই দূর্ঘটনা স্থলে না গিয়ে অন্য রুট ব্যবহার করবে।
Brake & Alert System
নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার জন্য সুইডিশ গাড়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘Volvo’ আবিষ্কার করেছে ‘Brake & Alert’ সিস্টেম।এই চমৎকার প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে গাড়ীর সামনে কোন পথচারী বা সাইকেল আরোহী এসে পড়লে গাড়ীর বাম্পারে যুক্ত সেন্সর বোর্ডের সাহায্যে সনাক্ত করতে পারবে।ফলে গাড়ীতে এলার্ম বেজে উঠবে এবং গাড়ীটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যাবে।
Driver alert system & Wifi Smartphone
যুক্ত্রাষ্ট্রের General Motors(GM) কোম্পানী wifi প্রযুক্তির সমন্বয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে স্মার্টফোনকে উপযোগী করে তুলেছে।গাড়ীচালকের কাছে থাকবে Driver alert system আর পথচারীর স্মার্টফোন ওয়াই-ফাই হটস্পট ছাড়াই তথ্য আদান-প্রদান করবে।ফলে পথচারী সামনে থাকলে স্মার্টফোন গাড়ীতে সংকেত পৌছে দিবে।
এছাড়া হাইওয়ে গুলোতে ৫০ কিঃমিঃ অন্তর অন্তর সিসি ক্যামেরার প্রচলন,কন্ট্রোল রুম,স্পীড গান,জিপিএস রাডার,প্রয়োজনীয় হাইওয়ে পেট্রোল কার দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
উল্লেখিত এই প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার যদি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা হয় তবে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন প্রকল্প অনেকাংশেই সফল হবে।
কিছুটা আশা কথা এই যে,বর্তমান সরকার নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার সাথে প্রযুক্তির সমন্বয়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য,১১-০৮-১১ তারিখে জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক প্রথম আলো’-তে ‘গাড়ির অবস্থান নির্ণয়ে জিপিএস(Global Positioning System) ব্যবহার বাধ্যতামূলক কতা হচ্ছে’ শীর্ষক শিরোনামে এক লেখা প্রকাশ করা হয়।সেখানে উল্লেখ্য করা হয় সরকার গাড়ীর অবস্থান ও গতি নির্ণয়ে এবং ছিনতাই প্রতিরোধে সকল গাড়ীতে জিপিএস ব্যবহার বাধ্যতামূলক করবে।
ফলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গাড়ীর অবস্থান খুব সহজেই নির্ণয় করা যাবে।এই যন্ত্রের দাম পড়বে ১২,০০০/= টাকা।এবং প্রতি মাসে মুঠোফোন কোম্পানীকে ৩০০/= টাকা লাইনভাড়া দিতে হবে।এছাড়া আরো উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশে বর্তমানে ২০ লক্ষ ৭ হাজার ৫০৩ টি প্রাইভেট কার ও স্টেন ওয়াগন,৯০ হাজার ৬৩৫টি মাইক্রোবাস,১২ হাজার ২৯৮টি ট্যাক্সি ক্যাব এবং ৮১ হাজার ৫৬১টি ট্রাক রয়েছে।
সর্বোপরি বলতে চাই,সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরী করতে হবে।তবেই ভবিষ্যত প্রজন্ম নিরাপদ ও নিশ্চিন্তে সড়ক পথ ব্যবহার করতে পারবে,নতুবা অকালেই ঝরে পড়বে অসংখ্য প্রাণবন্ত জীবন...।।
- ফেসবুকে আমিঃ দুরন্ত তৌফিক
- টুইটারে আমিঃ দুরন্ত তৌফিক
0 comments:
Post a Comment