লেখার শুরুতেই বলে রাখি আমি ন্যাশনাল  আইডিয়াল স্কুলের স্টুডেন্ট ছিলাম।ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলকে(NIS) চিনতে সমস্যা হলেও ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজের(NIC) কথার অনেকেরই জানার কথা।ঢাকার সেরা ১০টি কলেজের একটি NIC. NIS এ আমার শিক্ষাজীবন শুরু ৪র্থ শ্রেনীতে।স্কুল বলতে যা বোঝানো হয় তা হল- প্রকান্ড মাঠ,বিশাল লম্বা ক্লাস রুম,রুম ভর্তি ছাত্র-ছাত্রী ইত্যাদি।কিন্তু NIS ছিল ঠিক তার বিপরীত।মাঠ তো দূরের কথা স্কুলের সামনে দাঁড়ানোর জায়গাটা পর্যন্ত ছিল না।NIS এর শাখা ও ভবন অনেকগুলো।আমি প্রধান শাখা অর্থ্যাৎ খিলগাঁও শাখার ভবন-১ ও ২ -তেই স্কুলজীবনের উত্থান-পতন ঘটাই।স্কুল ভবন ছিল ঢাকার ১০ তলা একটা বিল্ডিং এর মত।শুনে আশ্চর্য হলেও ইহাই সত্য ও বাস্তব।স্কুল থেকে বের হলে সরাসরি মেইন রোড।আর ক্লাসরুমের হল
বাসার ছোট ছোট রুম গুলো যেমন দেখতে,অবিকল তাই!প্রতি রুমে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩০ কি ৩২ জনের উপরে কখনও দেখিনি বা শুনিনি।দেখবই বা কি করে? জায়গা হতে হবে তো? নাকি?

স্কুল থেকে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এমনকি শেষদিনটিও স্কুল নিয়ে বিরাট অফসোস হত।অন্যান্য স্কুলের মত আমার স্কুলে বড় মাঠ নেই।নেই বড় বড় ক্লাসরুম।কোন ক্লাব(Science/Debate) নেই।স্কুলে ক্যান্টিন বলতে যা আছে তা হল ৪ তলায় পার্টেক্স দিয়ে ঘেরাও করা একটা ছোট দোকান।তাছাড়া বছরের শেষ ক্লাসটাও উদযাপন করতে দেওয়া হত না।আজও মনে আছে,এস.এস.সি. পরীক্ষার পূর্বে শেষ ক্লাসে আমরা মোবাইল,ক্যামেরা,স্প্রে,জড়ি ইত্যাদি  Rag Day পালন করতে নিয়ে আসি।কিন্তু আমার নিষ্ঠাবান স্কুল সেই দিনও আমাদের জন্য সার্চ পার্টি পাঠালো।আমি আমার Sony Ericssion-w995 মোবাইল ও Sony DSC-W570 মডেলের ক্যামেরা দুই পায়ের জুতার ভিতর লুকিয়ে আসামীর মত দুই হাত উপরে তুলে উঠে দাড়ালাম।যথারীতি সার্চ পার্টি আমার বেঞ্চে আসে।আমার সর্বাঙ্গে তল্লাশী চালিয়ে কিছু না পাওয়ার হতাশায় তারা আমার নিরীহ ব্যাগটি সার্চ করতে শুরু করে।তখনই আমার মনে পড়ে যে,ক্যামেরার চার্জার তো ব্যাগের ভিতর!!!
স্যার মহাশয় সেই চার্জার পাইয়া বীরদর্পে হাসিয়া আমায় জিজ্ঞাসা করে,-"মূল বস্তুখানা কোথায় বৎস?"আমি অত্যন্ত নিরীহ গলায় জবাব দেই-"স্যার,এটা আমার নয়।পিছনের বেঞ্চের কারও হয়তো।" স্যার সত্য মানিয়া তখনকার মত আমাকে ইতস্ফা দিলেন।ক্লাস সার্চ করে প্রায় সবারই মোবাইল,ক্যামেরা,স্প্রে,জড়ি নিয়ে নেওয়া হয়।স্কুল ছুটির পর সবাই হেড স্যারের রুমে যায়,আমিও পিছু অনুসরণ করি।হেডস্যার ঘোষণা দেয়,জিনিসপত্র ফেরত নিতে হলে অভিভাবক নিয়ে আসতে হবে এবং বন্ডপেপারে সাইন আবশ্যক! নিকুচি করি চার্জারের!! বক্তব্য শোনা মাত্রই স্কুলের থেকে পগারপার। এই হল NIS. এখন আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন কেন NIS কে নিয়ে আমার আফসোস।
সেইদিনের পর কেবল SSC Result এর দিন NIS এ গিয়েছি।তারপর আর ঐ মুখো হইনি।ভবিষ্যতে যাব বলেও আশা করি না।কেননা অন্যান্য স্কুলের মত আমার জাতীয় আদর্শ বিদ্যালয়ে (NIS এর বাংলা রুপ) বিগত ১২ বছরে (২০০১-২০১২) কোনো Reunion হয়নি।আর SSC সংবর্ধনা দেওয়া হয় বলেও শুনিনি।স

স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে এসে স্কুলকে প্রায় ভুলতে বসেছি।এমন সময় শুনি NIS থেকে নাকি ২০১২ সালে এস.এস.সি তে জিপিএ-৫.০০ প্রাপ্তদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে।এ কি করে সম্ভব? :D যাক,অতশত চিন্তা করে লাভ নেই।দিবে যখন তখন নিয়ে আশাই শ্রেয়।
২৬ শে মার্চ,২০১৩।সকাল ১০.০০ টা। খিলগাঁও শাখার ৫ নং ভবনের সামনে হাজির।গিয়ে দেখি ৫ নং ভবনের নিচে গ্যারেজের ভিতরে স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তাদের অভিভাবকদের ভিড! কিন্তু কেন?আজ না আমাদের আসার কথা?তাহলে এরা কেন?চোখ পড়ল স্টেজে টানানো ব্যানারটার উপর।লাল রঙের ব্যানারে লেখা "বার্ষিক পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন-২০১৩" এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কেন এদের ভিড়।NIS কর্তৃপক্ষ সুনিপুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।বার্ষিক পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানের মাঝেই আমাদের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।একেই বুঝি বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা।
যাক,অনেকদিন পর কিছু স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে আবার দেখা হল।কারও চেহারাই তেমন পাল্টায় নি।পাল্টাবে কেন? ১বছরও তো হয়নি স্কুল থেকে বেরিয়েছে।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়।হেডস্যার মানে আমাদের শহীদুল্লাহ স্যারকে সেই চিরচেনা সাদা পাঞ্জাবী ও টুপিতে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।এই স্যার আমাদের সবসময় কলিজার টুকরা,হীরার টুকরা,মানিকের টুকরা ইত্যাদি নামে সম্ভাষণ করেন এবং আজও তাই করলেন।অনুষ্ঠান চলতে থাকল।স্কুল কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতা দিবস নিয়ে বক্তব্য দিলেন এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে হতাশার কথা ব্যক্ত করলেন।এরপর শুরু হল সূরা তেলোওয়াত,দেশাত্ববোধক গান,হামদ ও নাত ইত্যাদি।এখানে একটা কথা উল্লেখ্য,NIS এ Sports Day বলে কোনো কিছু পালন করা হত না।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নামে যা হত তা হল- সূরা,হামদ-নাত,দেশাত্ববোধক গান,সুন্দর হাতের লেখা ইত্যাদির প্রতিযোগিতা।নাচা-নাচি বা দৌড়াদৌড়ির স্থান এখানে ভুলেও আসত না।যাই হোক,এবার অনুষ্ঠানের পুরস্কার বিতরনী পর্ব।প্রথমে ১ম শ্রেনী থেকে ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত প্রতি ক্লাসে মেধাঅনুসারে ১ম,২য় ও ৩য় স্থান অধিকারীদের পুরস্কৃত করা হল।তারপর ৫ম ও ৮ম শ্রেনীতে বৃত্তিপ্রাপ্তদের পুরস্কার দেওয়া হল।এরপরে এল আমাদের সংবর্ধনার পালা।একসময় আমার নাম বলা হল।পুরস্কার নিতে উঠে দাড়ালাম।শহীদুল্লাহ স্যারের হাত থেকে পুরস্কার নিতে ভালোই লাগছিল।NIS স্কুল জীবনে আমার পুরস্কারের তালিকায় ছিল মাত্র একটা পুরস্কার।ষষ্ঠ শ্রেনীতে ১০০% উপস্থিতি ছিল তাই একটা ক্রেস্ট পেয়েছিলাম।আজ আরেকটা ক্রেস্ট পেলাম।তালিকা ১ থেকে ২ এ গিয়ে ঠেকল।
সংবর্ধনার পালা শেষ।এবার একটা মিষ্টির প্যাকেট দিলে পরিপূর্নতা আসে।৩০ মিনিটের মত অপেক্ষা করলাম।আশেপাশে কোথাও মিষ্টির প্যাকেটের কোনো চিহ্নই দেখলাম না।বুঝলে পারলাম বেশী আশা ভালো নয়।এবার বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম।জানি না পড়ে কেউ মিষ্টি পেয়েছিল কিনা !

এস.এস.সি.-এর পর অনেক জিপিএ-৫.০০ প্রাপ্তদের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই সংবর্ধনা দেওয়া হয়।আমি প্রথম
সংবর্ধনাটা নিয়েছিলাম 'প্রথম আলো' থেকে।প্রথম আলো সংবর্ধনার সাথে নন্দন পার্কে ও নিয়ে যাবে বলা হয়েছিল।আমার মূল আকর্ষন ছিল নন্দনে যাওয়া।আসলে বাঙ্গালী তো! ফ্রীতেই মূল আকর্ষণ।কিন্তু আজ NIS থেকে পাওয়া সংবর্ধনার কাছে প্রথম আলোর সেই সংবর্ধনা + নন্দনের টিকেট কিছুই না।অন্যান্য সব সংবর্ধনা থেকে স্বস্কুল থেকে পাওয়া SSC সংবর্ধনাটাই সেরা।সত্যিই এর তুলনা হয় না !

0 comments:

Post a Comment

 
Top