খোলা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে নম্রতাবাহিরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে।বৃষ্টির সাথে সাথে বইছে দমকা হাওয়া।মন বিষণ্ণ হয়ে আছে নাহলে এরকম সন্ধ্যেবেলার বৃষ্টিতে না ভিজে থাকা অসম্ভব।এই তো কিছুক্ষণ আগেও সম্পর্কটা ছিল এখন নেই।আচ্ছা সেদিনও তো এরকমই বৃষ্টি হচ্ছিল,তাই না?
 
কলেজের সাইন্স ফেয়ারে পরিচয় হয় আবিরের সাথে।দেখতে ভদ্র ও আচরণে মিশুক এই ছেলেটা প্রজেক্ট নিয়ে বসেছিলো নম্রতার ঠিক পাশের বুথে।তিনদিনের সাইন্স ফেয়ারে একা একা বসে থাকা বেশ একঘেয়েমি ধরিয়ে দেয়। নম্রতার অন্যপাশের বুথেই বসেছিলো তার বান্ধবী অরনীআবিরই প্রথম গল্প করা শুরু করে।  
-   এই যে আপু,আপনার প্রজেক্ট-টা কি জানতে পারি?   
-   হ্যাঁ অবশ্যই। প্রযুক্তির ব্যবহার করে কিভাবে সড়ক দূর্ঘটনা কমানো যায় তা নিয়ে বানানো। আপনারটা?

-   আমারটা আইটি প্রজেক্ট।সকল স্কুল-কলেজের তথ্য নিয়ে তৈরী ওয়েবপোর্টাল।
-   হুম। ভালো প্রজেক্ট।

-   তো আপু আপনার নাম?
-   নম্রতা

-   আমি আবির।সিটি কলেজে পড়ি।দ্বাদশ শ্রেনী
-   আমি এই কলেজেই। দ্বাদশ শ্রেনী

  - তাহলে তো তুমি করেই বলতে পারি , মাইন্ড করবেন না তো?
  -না মাইন্ড করব কেনো? একই তো ক্লাস।   
পরিচয়টা এভাবেই শুরু হয়।তারপর তিনদিনের ফেয়ারে বেশ অনেকবারই আবিরের সাথে গল্প করে সময় পার করেছিকিন্তু বিন্দুমাত্র মনে হয়নি ছেলেটাকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি   
ফেয়ার শেষ হলো। পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান আরও দশ দিন পর। ফেয়ার শেষে বাসায় ফিরে আসতে আসতে হঠ্যাৎ কেন যেন আবিরের সাথে কাটানো মূহূর্তগুলো মনে পড়তে লাগলো।নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করি,প্রেমে পড়লাম নাকি? নাহ! এ কি করে সম্ভব মাত্র ২/৩ দিনের চেনা।অগোছালো ভাবনাগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলামকিন্তু সম্ভব হলো না।সেদিনের পর থেকে বেশ কয়েকরাত খুব একটা ভালো ঘুম হলো না।
দেখতে দেখতে পুরস্কার বিতরণীর দিন এসে পড়ল।যারা ১ম,২য়,৩য় হয়েছে তাদের নাম কলেজের বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।আমি আইটি বিভাগে ১ম হয়েছে। ২য় হয়েছে... সে কি ঠিক দেখছি তো? হ্যাঁ এই তো, এটা তো আবিরের-ই নাম।হঠ্যাৎ কেন যেন বেশ লজ্জা লাগছেআবির নিশ্চয়ই আজ আসবে। হয়তো এসেও পড়েছে। পিছন থেকে কে যেন মাথায় টোকা দিল।

-   এই যে বিজয়িনী আপনার প্রজেক্ট তো ফাস্ট প্রাইজটা নিয়ে গেল
-    (হেসে) কখন এসেছো?  
-   এই তো আধ ঘন্টার মত হবে।তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
-   আমার জন্য? (ও কি আমার মতই...... )
-   নয়তো কার জন্য। সেই যে শেষ দেখা হলো তোমার নাম্বারটাও তো নেওয়া হলো না। নাকি দিতে চাচ্ছো না? না চাইলে সমস্যা নেই, অলরেডি আমি তোমার বন্ধবীর থেকে নাম্বার জোগাড় করে ফেলেছি।  
 নাম্বারটা অরনীর থেকে পায় আবিররাতে ফোন দেয়।আবিরের নাম্বার ফোনবুকে সেভ করার ছিল। মোবাইলের স্ক্রিনে আবির নাম দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।প্রেমে পড়লে কি মানুষের এরকম হয়? সামান্য একটা ফোন কলহয়তো ঠিকমত বাসায় পৌছেছি কিনা এটার জন্যই ফোন দিয়েছে।
-হ্যালো।
-হ্যালো নম্রতা আছে?
-আমিই তো নম্রতা।
- অ্যাঁ! ইয়ে..., আমি তো মনে করলাম তোমার কোনো বোন ধরেছে বোধ হয়।গলার স্বর তোমার একেবারে বাচ্চাদের মত শোনাচ্ছে। 
-আমার কথা তোমার কাছে বাচ্চাদের মত লাগে? (অভিমান করে)
-আরে আরে, রাগ করে না বাবু। আমি তো ফাইজলামি করছি।তোমার গলার স্বর তোমার মতই আছে। (হেসে)
- হুম। (মুচকি হেসে)
এই কথা সেই কথা বলতে বলতে একদিন আবির প্রপোজ করে বসেকলেজ ছুটি হয়েছে।প্রতিদিনকার মত আবির নিজের শেষ ক্লাসটা ফাঁকি দিয়ে আমার কলেজের সামনে এসে অপেক্ষা করছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা।বেশ হাওয়া বইছে।কলেজ থেকে বের হয়েই আবির এর সাথে দেখা করি কলেজের সামনের রেস্তরায়।
-   আজ ভাবছি হেঁটে বাসায় যাব। রিকশা নেওয়ার দরকার নেই।বৃষ্টিত ভিজব।
-   পাগল নাকি! মা যদি দেখে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি মেরেই ফেলবে।
-   বলবি রিকশা নেই। 

আমি আর না করলাম না। দুজনে হাটা শুরু করলাম। বৃষ্টির আগমনের লক্ষণ হিসেবে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি  পড়ছে।

-   নম্রতা। তোকে একটা কথা বলি?
-   হুম, বল
-   তোর কেমন জামাই পছন্দ?  
-   (হেসে) মানে? হঠ্যাৎ এই প্রশ্ন?
-   আহা! বলই না
-   জানিনা তো।
হঠ্যাৎ খুব জোরে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো।আমি সামনে পা বাড়াতেই আবির আমার হাত ধরে ফেলল।আমি অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাই।
-   একটু দাঁড়া। বৃষ্টিতে ভিজলে তোকে কেমন লাগে দেখে রাখি।
-   কি বলছিস আবোল-তাবোল?
-   আবোল-তাবোল না। তোকে আজ একটা কথা বলব,হয়তো শোনার পর তুই আমার সাথে আর মিশবি না।কিন্তু না বলেও আমি থাকতে পারছি না।
আমি... আমি তোকে ভালবাসি নম্রতা।
ইতস্ত করে বলা “আমি তোকে ভালবাসি নম্রতা ” – এই বাক্যটি শোনার জন্য আমি সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি। আজ আমার স্বপ্ন পুরনের দিন।তৎক্ষণাৎ আমি কোনো উত্তর না দিলেও অরনীকে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম পরে। আমিও তোকে ভালবাসি,আবির।  সেদিনও বৃষ্টি ছিল, আজও।

প্রায় পাঁচ বছরের সম্পর্ক আমাদের।কত সুখ-দুঃখ,পাওনা-না পাওয়া মিশে আছে আমাদের এই সুদীর্ঘ সম্পর্কে। সামনের বছর আবিরের মাস্টার্স শেষ হবে।আমার বিয়ের ঘটক এই কয়েক বছরে শ-খানেকের মত পাত্র এনে দেখিয়েছে, বিভিন্ন অযুহাতে বিয়ে থেকে দূরে সরেছিলাম।কেবল ওর জন্যই অপেক্ষা।কিন্তু...।।


মাস্টার্সের রেজাল্টের এক মাস আগে ক্যান্সার ধরা পড়ে ওর।এ এমন এক রোগ যার থেকে বাঁচা অসম্ভব। তবুও কেন যেন বিশ্বাস হতো ও বাঁচবেঈশ্বর আমার সাথে এত বড় খেলা করতে পারে না।সাহস যুগিয়েছি ওকে।আশার বানী শুনিয়েছি।রোগ ধরা পড়ার পর, ও শুধু একটা কথাই বলত “ আমাকে ভুলে যেও নম্রতা। আমি আর সব সহ্য করতে পারবো কিন্তু তোমার চোখের জল আমি দেখতে পারব না। কথা দাও আমায় আমি মরে গেলেও তুমি হাসবে। কথা দাও।” কথাগুলো শুনে চোখে জ্বল এসে পড়ত। তবুও শক্ত হয়ে থাকতাম।আমি কেঁদে ফেললে ও সাহস পাবে কোথা থেকে?


চার মাস প্রাণপণ লড়াইয়ের পর আজ ও নীরব।একটু আগে ওকে শেষ দেখা দেখে বাসায় এসেছে।যেন বেশ কয়েকদিন পর ও প্রশান্তিতে ঘুমোচ্ছে।ওর ঠোঁটে হাসি লেগে আছে।না, আমি কাঁদিনি। আমি তো কথা দিয়েছি আমি কাঁদব না।আমি পারব না ওকে কষ্ট দিতে।কিছুক্ষণ আগেও সম্পর্কটা ছিল,এখন নেই...।। তবুও আমি কাঁদব না। ও যে সহ্য করতে পারবে না। 

0 comments:

Post a Comment

 
Top